রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী:
যেখানে একপায়ে বাংলাদেশ, আরেক পায়ে বিস্ময়…
১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | জাফলং, সিলেট, বাংলাদেশ
[ভ্রমণনামা × সীমান্তচিন্তা × বাস্তবতা]
ভ্রমণ কেবল গন্তব্য নয়, ভ্রমণ অনেক সময় সত্যকে ছুঁয়ে দেখার নাম। গত বছর যত জায়গা ঘুরেছি, তার মধ্যে একটিকে আলাদা করে মনে রেখেছে মন—জাফলংয়ের সীমান্ত। এখানে এসে যেন দেখলাম—সীমানা আসলে শুধু লাইন নয়, সেটা এক গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতা, এক নীরব কাব্যও বটে।
জাফলং সীমান্তে পা রাখতেই মনে হলো—পৃথিবীর সবচেয়ে নরম সীমারেখা বোধহয় এখানেই।
না, এখানে কোনো কাঁটাতার নেই। নেই উঁচু দেয়াল কিংবা শক্তপোক্ত নজরদারির যন্ত্র। আছে শুধু কিছু পাথরের সারি, যেগুলোর উপর চুনকাম করে টানা হয়েছে দু’দেশের আলাদা পরিচয়। একপাশে বাংলাদেশ, আরেকপাশে ভারত। মাঝখানে নদী, পাহাড়, আর আকাশভরা নৈঃশব্দ্য। কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের মাঝেও শোনা যায় একটি রাষ্ট্রের সজাগ নিঃশ্বাস।
চারপাশে দেখি পর্যটকদের আনাগোনা—কেউ পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউবা অজান্তেই সীমানা পেরিয়ে ফেলছেন। হঠাৎ ওপার থেকে ভেসে আসে একটি কণ্ঠ—
“এধার যাও!”
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (BSF) নির্দেশ।
এক মুহূর্তে হালকা ভ্রমণ রসের ভেতর ঢুকে পড়ে আন্তর্জাতিক বাস্তবতা।
আমার চোখ পড়ে এক বিজিবি সদস্যের দিকে—চুপ করে ঝোপের আড়ালে বসে আছেন, যেন সময়ের জন্য অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পরই দূর থেকে কয়েকজন ভারতীয় নারী থলে হাতে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসেন। সেই মুহূর্তে যেন একটা অদৃশ্য অ্যালার্ম বেজে ওঠে। বিজিবি সদস্য বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করে দেন, সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও ছুটে আসেন।
সীমান্ত শুধু ভূগোল নয়, সেটা দায়িত্বের এক কঠিন ব্যাকরণ।
এই ঘটনাটি আমার মনে জাগিয়ে তোলে গভীর শ্রদ্ধা আমাদের সীমান্তরক্ষীদের প্রতি। তাঁরা ছায়ার মতো, নীরবে পাহারা দেন রাষ্ট্রের মর্যাদা। কিন্তু প্রশ্নও জাগে—এত সহজেই যদি মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে, তবে আমরা কি সত্যিই সুরক্ষিত?
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কাঁটাতার বা দৃশ্যমান সীমাবেষ্টন একটি কার্যকর প্রতিরোধ হতে পারে চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের বিপরীতে—শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সীমান্ত-নীতি অনুযায়ী একটা ‘ডিটারেন্স’ হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই ভ্রমণে আমার সঙ্গী ছিল সুভ সরদার (সুভ-দা)।
তাঁর মুখে একটা কথাই বারবার বাজছিল—
“চট করে ঢুকে পড়ি না হয়?”
জাফলংকে আর কেবল পাহাড় আর নদীর জন্য মনে থাকবে না আমার—
মনে থাকবে এটি একটি সীমারেখার প্রতিচ্ছবি,
যেখানে মানুষের স্বাধীনতা আর রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে,
নীরবে… সম্মানে… আর সতর্কতায়।